বুদ্ধপ্রতিমা কী ও কেন এবং এর পূজার ফল কী লিখেছেন জ্ঞানশান্ত ভান্তে
বুদ্ধপ্রতিমা হচ্ছে এক প্রকার চৈত্য বা জাদী। নিধিকণ্ড সূত্রের অর্থকথায় বলা হয়েছে- বুদ্ধপটিমা উদ্দিস্সকচেতিযং। অর্থাৎ বুদ্ধপ্রতিমা হচ্ছে উদ্দেশিক জাদী। এরকম উদ্দেশিক জাদী শুধু বর্তমানে প্রচলিত বুদ্ধপ্রতিমা নয়, অন্যকিছুও হতে পারে। সেখানে বুদ্ধের প্রতি মমতা জাগে এরকম যেকোনো জিনিসই বুদ্ধের উদ্দেশ্যে চৈত্য বা জাদী হতে পারে। তাই জাতক অর্থকথায় বলা হয়েছে, উদ্দিস্সকং অৰত্থুকং মমাযনমত্তমেৰ হোতি।[^4] অর্থাৎ উদ্দেশিক জাদীতে বিশেষ কোনো জিনিস লাগে না। কোনো একটা জিনিসকে ভিত্তি করে বুদ্ধের প্রতি ভক্তি উৎপন্ন হলেই তা উদ্দেশিক চৈত্য হয়।
নিজস্ব ছবি: ছৈলেংটা বনবিহার |
একারণেই বর্তমানে যদিও উদ্দেশিক চৈত্য হিসেবে বুদ্ধপ্রতিমা বহুল প্রচলিত, বুদ্ধের পরিনির্বাণের প্রথমদিকে কিন্তু সেরকম ছিল না। তখন কেবল একটা বোধিবৃক্ষের পাতার ছবি, অথবা ধর্মচক্র এসব চিহ্নকে বুদ্ধের উদ্দেশ্যে পূজা করা হতো। এমনকি বুদ্ধের পরিনির্বাণের দুইশ বছর পরে তৃতীয় সঙ্গীতির পরেও তখনো কোনো বুদ্ধপ্রতিমা ছিল না। তাই আমরা পারাজিকা অর্থকথায় দেখতে পাই, মহিন্দ ভান্তে বোধিবৃক্ষকে বন্দনা করার জন্য শ্রীলঙ্কা থেকে ভারতে ফিরতে চেয়েছিলেন। কারণ বুদ্ধকে বন্দনা না করতে না পেরে তার থাকতে ইচ্ছে করছিল না। পরে তার বোন সংঘমিত্রা ভারত থেকে বোধিবৃক্ষের শাখা নিয়ে যান শ্রীলঙ্কায়। মহিন্দ ভান্তে তখন সেই বোধিবৃক্ষকে পূজা করেন। সেটা ছিল অশোক রাজার আমলে, অর্থাৎ খ্রিস্টপূর্ব ২০০ অব্দের দিকে।
পরবর্তীতে শ্রীলঙ্কায় বুদ্ধপ্রতিমার প্রচলন শুরু হয় বহুলভাবে, যেটা আমরা মহাবংশে প্রচুর দেখতে পাই। এই মহাবংশ গ্রন্থটি হচ্ছে শ্রীলঙ্কার রাজবংশগুলোর একটি প্রামাণ্য দলিল, যেটা ঐতিহাসিকেরা এক বাক্যে স্বীকার করেন। সেখানে আমরা দেখতে পাই, শ্রীলঙ্কার মহাবিহারের মহাবোধি প্রাঙ্গণে বসভ রাজা চারটি রমণীয় বুদ্ধপ্রতিমা নির্মাণ করিয়েছিলেন। তার মানানসই করে প্রতিমাঘর নির্মাণ করেছিলেন। উইকিপিডিয়ামতে, সেই বসভ রাজার রাজত্বকাল ছিল ৬৭-১১১ খ্রিস্টাব্দ। সেটা এখন থেকে প্রায় ২০০০ বছর আগে। তার মানে ধরে নেয়া যায় বুদ্ধপ্রতিমার প্রচলন শুরু হয়েছিল প্রথম শতকের দিকে।
আর সেই বুদ্ধপ্রতিমা মহাবিহারেই স্থাপিত হয়েছিল। শ্রীলঙ্কার মহাবিহার ছিল ঐতিহাসিকভাবেই থেরবাদী ভিক্ষুদের প্রধান কেন্দ্র। এই মহাবিহারের ভিক্ষুরাই ত্রিপিটককে অক্ষুণ্ণভাবে ধরে রেখেছিল শত প্রতিকুলতার মুখেও। এমন নিবেদিতপ্রাণ মহাবিহারেও এত হাজার বছর আগেও বুদ্ধপ্রতিমার ঘর ছিল। তাই এই বুদ্ধপ্রতিমার প্রচলন ও পূজাকে বৌদ্ধ ইতিহাসের ঐতিহ্য বলে বুঝতে হবে, বৌদ্ধ ইতিহাস কর্তৃক অনুমোদিত বলে বুঝতে হবে।
বুদ্ধপ্রতিমাকে কেন পূজা করা হয়
বুদ্ধপ্রতিমা হচ্ছে উদ্দেশিক জাদী। সেই উদ্দেশিক জাদীকে পূজা করলে কী হয়? নিধিকণ্ড সূত্র বলছে, অসাধারণ পুণ্য হয়, যা দীর্ঘকাল ধরে জন্মে জন্মে সুখময় ফল দানের সামর্থ্য রাখে। একারণেই বুদ্ধ নিধিকণ্ড সূত্রে পুণ্যকে সবচেয়ে অজেয় ধন বলেছেন। অনুগামী ধন বলেছেন। কেন অজেয় ধন হয়? পুণ্য হচ্ছে এমন এক প্রকার ধন, যা অন্য কেউ হরণ করতে পারে না। সেই ধনের মালিক একমাত্র আপনি। তাই সেটা অজেয় ধন। অনুগামী ধন কেন হয়? কারণ বুদ্ধ বলেছেন, কম্মস্সকা মাণৰ সত্তা।[^5] অর্থাৎ হে তরুণ, প্রাণিদের কর্মই হচ্ছে আপন, অন্য কেউ নয়। সেটাই মরণের পরে ভবিষ্যৎ জীবনের পাথেয় হয়। স্বামী স্ত্রী পুত্র কন্যা আত্মীয়স্বজন বন্ধুবান্ধব কেউই আপনার মরণের পরে পরকালে অনুগামী হয় না, হতে পারেও না। একমাত্র অনুগামী হয় এই পুণ্য। তাই সেটা অনুগামী ধন।
এই অজেয় অনুগামী ধনকে পাওয়ার জন্যই আমরা বুদ্ধপ্রতিমাকে পূজা করি। প্রতিদিন পূজা করি। সকাল বিকাল পূজা করি। এভাবে আমরা অজেয় ধন কামাই। অনুগামী ধন কামাই। তাই যদি প্রশ্ন করা হয়, কেন বুদ্ধপূজা করেন, তাহলে উত্তর দেয়া উচিত – পরকালের ধনের জন্য। চাকরি ব্যবসাবাণিজ্য চাষবাস সবই হচ্ছে ইহকালের ধনের জন্য। কিন্তু বুদ্ধপূজা হচ্ছে পরকালের ধনের জন্য!
উদ্দেশিক জাদীতে পূজার উদাহরণ
মায়ানমার ও থাইল্যাণ্ডে প্রতি বছর বালুচরে বালু দিয়ে জাদী বানিয়ে পূজা করা হয়। সেটা হচ্ছে উদ্দেশিক জাদী। কার উদ্দেশ্যে সেই জাদী বানানো হয়? বুদ্ধের উদ্দেশ্যে। কার উদ্দেশ্যে সেই জাদীকে পূজা করা হয়? বুদ্ধের উদ্দেশ্যে। তাই সেই জাদীকে পূজার ফল হয় অসাধারণ।
উদাহরণ হিসেবে আমরা অপদান গ্রন্থে দেখি, পুন্নাগ পুষ্পীয় স্থবিরের কাহিনী। তিনি নাকি অতীতে এক জন্মে ব্যাধ হিসেবে জন্মেছিলেন। একদিন তিনি বনে ফুটে থাকা পুন্নাগ ফুল দেখে সেই ফুল ছিঁড়ে নিয়ে বুদ্ধকে স্মরণ করে বালুতে জাদী বানিয়ে সেই ফুল দিয়ে পূজা করলেন। তিনি সেই পুণ্যফলে বিরানব্বই কল্প ধরে কেবল দেবতা ও মানুষ হিসেবে জন্মেছিলেন। কখনো দুর্গতিকুলে জন্ম নেন নি। পশুপাখি হিসেবে জন্ম নেননি। নরকে জন্মাননি। পরে এই বুদ্ধের আমলে ভিক্ষু হয়ে অর্হৎ হন। একবার মাত্র বুদ্ধের উদ্দেশ্যে বালুচরে জাদী বানিয়ে ফুল দিয়ে পূজা করার এত ফল হয়। তাহলে আমরা কেন সেই বুদ্ধপ্রতিমাকে প্রতিদিন পূজা করব না?
আর একটা কথা চিন্তা করুন। তিনি সেই জন্মে ব্যাধ হয়েছিলেন। জাদী পূজা করে কিন্তু তিনি সেই জন্মে ধনী হন নি, কোনো কিছু হন নি। তাই বলে কি তিনি সেই জাদী পূজার ফল পান নি? পেয়েছেন। তিনি সেই জন্মে মৃত্যুর পরে সুগতিতে জন্মেছেন। বার বার জন্মেছেন। সেটাই হচ্ছে জাদী পূজার ফল। বুদ্ধপূজার ফল। [^6] এরকমভাবে অনেক স্থবির অতীতে বনে জঙ্গলে বুদ্ধের উদ্দেশ্যে জাদী বানিয়ে পূজা করেছিলেন। সেই পূজার ফলে বহু কল্পকাল ধরে জন্মে জন্মে সুখের অধিকারী হয়েছিলেন। অপদান গ্রন্থে সেরকম অনেক স্থবিরের কাহিনী আছে। [^7]
তাই বুদ্ধপ্রতিমা পূজা করুন। প্রতিদিন করুন। জীবন্ত বুদ্ধকে পূজা করার মতো করে পূজা করুন। সিয়ং দান করুন। পরকালের জন্য পুণ্য সঞ্চয় করুন। ঐ বিরুদ্ধবাদীদের কথায় ভয় পেয়ে বুদ্ধপূজা না করা মানে হচ্ছে অজেয় অনুগামী ধন সঞ্চয়ের সুযোগকে নষ্ট করা। এভাবে পুণ্য সঞ্চয় না করে শুধু শুধু নিজের ভবিষ্যৎ জন্মগুলোকে দুঃখময় করার কোনো মানে আমি দেখি না।
বুদ্ধপ্রতিমাকে পূজার ফল কী
এর উত্তর জানতে হলে আগে আমাদের জানা উচিত বুদ্ধপ্রতিমা কী। বুদ্ধপ্রতিমা হচ্ছে বুদ্ধের প্রতিমূর্তি। সেটা ইট কাঠ পাথর অথবা বালু দিয়ে অথবা অন্য যেকোনো কিছু দিয়ে বানানো মূর্তি হতে পারে। আগ্রহীরা অনেকেই অবশ্য রূপা, পিতল ইত্যাদি দিয়েও বুদ্ধপ্রতিমা বানায়।
সেটা যেভাবেই বানানো হোক, কথা হচ্ছে বুদ্ধমূর্তিকে দেখতে হয় শ্রদ্ধার চোখে। সেই শ্রদ্ধাবান বৌদ্ধ উপাসক বা উপাসিকার চোখে সেটা মূর্তি তো নয়, যেন জীবন্ত বুদ্ধ। তাই তারা জীবন্ত বুদ্ধকে পূজা করার মতো করে পূজা করে থাকে।
কিন্তু যারা চোখে অশ্রদ্ধা নিয়ে দেখে, তারা সেটাকে ইট কাঠ পাথরের একটা স্তুপ হিসেবে দেখে। আর সেটাকে বন্দনা ও পূজাকারীদেরকে তারা উপহাস করে। সেটা কেন করে? কারণ বুদ্ধের প্রতি তাদের ন্যূনতম শ্রদ্ধা নেই।
ব্যাপারটা বুঝার জন্য আমি একটা উদাহরণ দিতে পারি। ধরা যাক, আপনারা একজনের ঘরে গিয়ে হয়তো দেখলেন সে ঘরে তার পিতামাতা ও পূর্বপুরুষদের ছবি টাঙ্গিয়ে রেখেছে। মূর্তি করে রেখেছে। তার কারণ কী? সেই পিতামাতা ও পূর্বপুরুষদের প্রতি তার রয়েছে অগাধ শ্রদ্ধা। সে তার মনের মধ্যে তাদের জন্য একটা জায়গা করে দিয়েছে। মনে জায়গা হলেই ঘরেও জায়গা হয়। মনে জায়গা না দিলে আপনি ঘরেও জায়গা পাবেন না।
কিন্তু ধরা যাক একজন চোর ঢুকল তার ঘরে। চোরের মনে তো সেই ছবিগুলোর প্রতি কোনো দয়ামায়া নেই। সেগুলো তার কাছে ছবি মাত্র। ইট কাঠ পাথরের মূর্তি মাত্র। তাই সে সেগুলো সে তছনছ করল নির্দ্বিধায়। সেগুলো ভেঙে চুরে দেখতে লাগল সেগুলোর মধ্যে কোনো মূল্যবান জিনিস লুকোনো আছে কিনা।
দেখলেন তো? এখানে ছবিগুলোর প্রতি, মূর্তিগুলোর প্রতি দুজনের দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে বিশাল পার্থক্য। একজনের মনে ছবিগুলোর প্রতি, মূর্তিগুলোর প্রতি অগাধ শ্রদ্ধা। তাই সেগুলোকে সে রাখে সযতনে। আরেকজনের মনে সেগুলো ইট কাঠ পাথরের মূর্তি মাত্র। তাই সে সেগুলোকে ভেঙে চুরে ফেলতে দ্বিধা করে না।
এগুলো মূলত কিছু উগ্রবাদী মুসলিমদের মূর্তিপূজা বিরোধী মানসিকতা। এজন্য তারা এমনকি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাস্কর্য পর্যন্ত ভেঙে দিতে দ্বিধা বোধ করে না।
আমাদের মাঝেও কিছু বৌদ্ধ নামধারী ইসলামপন্থী রয়েছে যারা বুদ্ধমূর্তিকে পারলে ভেঙেচুরে গুঁড়িয়ে দিতে চায়। এরা তাদের নিজস্ব ভ্রান্ত দৃষ্টিভঙ্গিকে অন্যদের উপর ছলে বলে কৌশলে চাপিয়ে দিতে চায়। তারা সমাজের মধ্যে লোকজনের মধ্যে বিদ্যমান সুসম্পর্ককে নষ্ট করে। এই এরকম মুর্খ লোকদের কাছ থেকেই বুদ্ধ বহু দূরে থাকতে বলেছেন। এমনকি তাদের কথা শোনাও পাপ হয়। তাই পারতপক্ষে তাদের থেকে দূরে থাকুন। না পারলে যতটা সম্ভব এড়িয়ে চলুন। তাদের থেকে হাজার মাইল দূরে থাকা ভালো।
রেফারেন্স
[^4]: জাতক-অট্ঠকথা-৪ => ১৩. তেরসকনিপাতো
[^5]: উপরিপণ্ণাসপাল়ি => ৪. ৰিভঙ্গৰগ্গো
[^6]: অপদান-অট্ঠকথা => ১৬. বন্ধুজীৰকৰগ্গো => ৯. পুন্নাগপুপ্ফিযত্থেরঅপদানৰণ্ণনা
[^7]: অপদানপাল়ি-২ => ৪৩. সকিংসম্মজ্জকৰগ্গো => ৯. সোৰণ্ণকিঙ্কণিযত্থেরঅপদানং
Post a Comment